মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য জুতা
ভুমিকাঃ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য হিসাবে জুতাকে ধরা হয়। এক এক দেশে জুতার চাহিতা এক এক ধরনের। বৃটেনের পুরুষেরা সরু মাথা এবং চকচকে জুতা পরিধান করে । অন্যদিকে মানানসই সুন্দর জুতা পরলে মহিলাদের আবেদনময়ী দেখায় । তবে কথায় আছে, যার পায়ে জুতা, সেই জানে কোথায় খোঁচা লাগে । ইতিহাসঃ জুতার ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন । বলা হয়, গরম এবং ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে পা রক্ষা করার জন্য স্যান্ডেল ও জুতা আবিস্কার করা হয়েছিল । গরম আবহাওয়ার জন্য মিশরীয়রা প্রথম স্যান্ডেল আবিস্কার করে এবং শেষ বরফ যুগে শীতের প্রকোপ থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য জন্তু-জানোয়ারের চামড়া দিয়ে প্রথম জুতা বানানো হয় । ১৯৩৮ সালে আমেরিকার অরিগন রাজ্যের ফোর্ট রক গুহায় খুঁজে পাওয়া স্যান্ডেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেছে, সেই স্যান্ডেল খৃস্টপূর্ব সাত বা আট হাজার বছরের পুরোনো। সময় এবং চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্য্যন্ত বিভিন্ন ধরনের জুতা আবিস্কৃত হয়েছে । তবে এ বছরের আগষ্ট মাসের শেষে নির্মাতারা ঘোষণা করেছেন, শীঘ্রই বাজারে এমন এক বিশেষ ধরনের ‘বুদ্ধিমান’ জুতা পাওয়া যাবে, যা পথচারিকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যাবে এবং অতিক্রান্ত পথের দূরত্বও পরিমাপ করবে । গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) প্রযুক্তির মাধ্যমে এ জুতা কাজ করবে । জুতার সুকতলায় সংযুক্ত ব্লুটুথের সঙ্গে স্মার্ট মুঠোফোনের বিশেষ অ্যাপস্ লাগানো থাকবে এবং স্মার্টফোনের এই অ্যাপসের মাধ্যমে গুগল ম্যাপ থেকে নির্দেশনা নিয়ে এই ‘হাইট্যাক’ জুতা পথচারীকে পথ দেখাবে। এছাড়া এ জুতা যে স্মার্ট মুঠোফোনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে, সেই ডিজিটাল মুঠোফোন ছেড়ে নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে গেলেই বিশেষ সংকেত দিবে এবং মুঠোফোন হারানোর ঝুকি কমবে । এই ‘বুদ্ধিমান’ জুতার নাম রাখা হয়েছে ‘লে চল’ (চল যাই), যার আবিস্কারক দুজন স্নাতক ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস্টিয়ান লরেন্স এবং অনিরুদ্ধ শর্মা । যাহোক, জুতা যে আমাদের শুধু ধূলাবালির হাত থেকে রক্ষা করে, পায়ের শোভা বর্ধন করে এবং পথ চলার সময় দিক-নির্দেশনা দিবে, তাই নয় । পা থেকে বেরিয়ে এসে জুতা পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের লোকজ ও আধুনিক শিল্প-সাহিত্য এবং সঙ্গীতাঙ্গনে উঠে এসেছে । উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত প্রখ্যাত ড্যানিশ লেখক হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের জুতা নিয়ে বিখ্যাত শিশুতোষ গল্প ‘দ্য রেড সুজ’ । তবে তার আগেও জুতা নিয়ে লোককাহিনী রচিত হয়েছে । এদের মধ্যে ১৭৬৫ সালে প্রকাশিত ‘লিটল গুডি টু সুজ’ অন্যতম । রাজনীতিকে উদ্দেশ্য করেও জুতা নিয়ে সাহিত্য রচনা করা হয়েছে । ১৯০০ সালে ফ্রাঙ্ক ব্রাউন রচিত ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল উইজার্ড অফ ওজ্’, যা আমেরিকার গৃহ যুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) রাজনৈতিক বিষয়কে উপজীব্য করে লেখা হয়েছে । এছাড়া জুতা নিয়ে ছোটদের জন্য বিখ্যাত ইংরেজি ছড়া রয়েছে ‘ওয়ান, টু, বাকল্ মাই শু’ । জুতার সরব উপস্থিতি সঙ্গীতেও দেখা যায় । ভারত স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে বলিউডের বিখ্যাত ‘শ্রী ৪২০’ ছায়াছবির গীতিকার শৈলেন্দ্ররের লেখা, সুরকার শংকর জয়কিষণের সুর, প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী মুকেশের গাওয়া এবং অভিনেতা রাজ কাপুরের ঠোঁটে আজো যে গান বিন্দুমাত্র আবেদন হারায়নি, সেই গানের প্রথম কলিতেই জুতার কথা রয়েছে । গানের প্রথম দু’কলি: ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, ইয়ে পাৎলুন ইংলিশস্তানি/ সার পে লাল টপি রুশি, ফির ভি দিল্ হ্যায় হিন্দুস্তানি ।’ তবে পশ্চিমা বা বিদেশী শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীতে জুতার কদর বা বিশেষত্বের মতো বাংলা শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতেও জুতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । সেই কবে জুতা আবিস্কারের কাল্পনিক কাহিনী নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘জুতা আবিস্কার’ । এছাড়া অনেক বছর আগে জুতা নিয়ে একটা প্যারোডী পড়েছিলাম । কার লেখা, কোথায় এবং কখন পড়েছি, আজ কিছুই মনে নেই । তবে প্যারোডীর কথাগুলো আজো স্পষ্ট মনে আছে, ‘জুতা রাষ্ট্র করে দেয় পেলে কোনো ছুতা/ আমার প্রধান শত্রু হাই হিল জুতা’ । এছাড়া আমাদের দেশে তো বহুল ব্যবহৃত প্রবাদই আছে, ‘গরু মেরে জুতা দান ।’ জুতার প্রতি নেক বা একধরনের বিশেষ দুর্বলতা কম-বেশি সবারই আছে । টেকসই, সুন্দর এবং ভালো জুতা পরতে কে না চায় ? তবে এ ব্যাপারে ফিলিপাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্ত্রী ইমেলদা মার্কোসের নাম সবার আগে । বিশ্বের সর্বাধিক জুতার (সাড়ে তিন হাজার জোড়া) মালকিন হিসাবে ইতিহাসের পাতায় তার নাম লেখা হয়েছে । অন্যদিকে সম্প্রতি ‘অ্যামেরিকা গট টেলেন্ট’ (দ্বিতীয় পর্ব) শো-র ফিন্যালে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক নিক ক্যানন এক জোড়া বিশেষ জুতা পরিধান করেন । সেই জুতার মূল্য মাত্র দুই মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। জুতার বিশেষত্ব হচ্ছে শ্বেত স্বর্ণের উপর ১৪০০০ ফুল-কাট গোলাকৃত ৩০ ক্যারাটের হীরক নিখুঁত ভাবে বসানো হয়েছে । এতে কারিগরের মোট দুই হাজার ঘন্টারও বেশি সময় লেগেছে । এই জোড়া জুতা বিশ্বের সবচেয়ে দামি জুতা হিসাবে ‘গিনিস ওয়ার্ল্ড বুক’-এ জায়গা করে নিয়েছে । জুতা কি শুধু পায়ে পরিধান করে ধূলাবালির হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়া, পায়ের শোভা বর্ধন করা এবং ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও প্রাচুর্য্য প্রতীক, নাকি শিল্প-সাহিত্য ও সঙ্গীত ভুবনের একটা বিষয় ? জুতার আরো অনেক ব্যবহার আছে। যেমন প্রচন্ড ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং তীব্র প্রতিবাদের ভাষা জুতা নিক্ষেপ বা ছোড়াছুড়ি এবং জুতা প্রদর্শন । যেহেতু জুতার সঙ্গে রাস্তার ময়লা এবং ধূলাবালির একটা মাখামাখি সম্পর্ক রয়েছে, তাই কারোর প্রতি জুতা নিক্ষেপ বা জুতা দেখানোর অর্থ হচ্ছে তার প্রতি অবজ্ঞা এবং লাঞ্ছনার বহির্প্রকাশ । যাহোক, এই জুতা নিক্ষেপের ইতিহাস খুব বেশি দিনের পুরোনো নয় । বর্তমানে বিশ্বের অনেক জায়গাতেই জুতা ছোড়াছুড়ির ঘটনা দেখতে পাওয়া যায় । তবে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা শুরু হয়ছে ২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আমেরিকান দূতাবাসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে। সেই সম্মেলনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে উদ্দেশ্য করে সাংবাদিক মুনতাদার আল-জাইদি জুতা ছুড়েছিল । বিশ্বের গণমাধ্যমে এই ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে । পরবর্তীতে জুতা নিক্ষেপের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন পরিবেশে । জর্জ বুশের ঘটনার পর যারা এই জুতা নিক্ষেপের মুখোমুখি হয়েছেন, তারা হলেন অষ্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড, পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশররফ, বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিন্টন, ইরানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ, চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট মা ইং-জিও, সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বাশির, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়িপ আর্ডোগ্যান, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারী এবং গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপানদ্রেও । উল্লেখ, জুতা প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনে মোবারকের বিরুদ্ধে । শুধু কি বিদেশের মাটিতেই জুতা নিক্ষেপ বা জুতা প্রদর্শনের ঘটনা ঘটছে । না, বাংলাদেশেও সেসব ঘটনার জোর হাওয়া এসে লেগেছে । তবে আমরা একজন অন্যকে জুতা দেখাই । জুতা পায়ে হাঁটার সময় কোনো কারণে অন্যমনস্ক হলে অনেক সময় লজ্জাজনক এবং বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় । যেমন গত ২০১২ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি ভারত সফরে নয়া দিল্লীর গান্ধী মেমোরিয়াল প্রদর্শন করার সময় অষ্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড হাই হিল জুতা পড়ে পা ফসকে পড়ে যান । তার হাই হিল ভেজা ঘাসের মধ্যে আটকে গিয়েছিল । সেই বিব্রতকর ছবি সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচারিত হয় । এছাড়া ‘জুতা মারা’ একটা শাস্তিযোগ্য বিষয়, যা সরাসরি কারোর উপর প্রয়োগ না করে মুখে বললেও যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়, সেটা তার কাছে অপমান এবং শাস্তি হিসাবে পরিগণিত হয় । এধরনের জুতা মারার শাস্তি এখনো গ্রামবাংলায় প্রচলিত আছে । মোদ্দা কথা, ঘৃণা-বিদ্বেষের জন্য কারোর প্রতি জুতা নিক্ষেপ করা বা অনিয়ম ও দুর্নীতি অভিযোগে কারোর বিরুদ্ধে জুতা প্রদর্শন করে রাস্তায় মিছিল করা, অপরাধের শাস্তি হিসাবে কাউকে জুতা দিয়ে আঘাত করা, কিংবা মুখে ‘জুতা মারা’ বলা এবং চেয়ারে বসে কারোর দিকে মুখ করে জুতার তলা দেখানোও রীতিমতো অপমানজনক বিষয় এবং সামাজিক ভাবে অগ্রহণযোগ্য । উপসংহারঃ আমরা, নিরীহ সাধারণ মানুষেরা নিক ক্যাননের মতো হীরক খচিত মহামূল্যবান জুতা চাই না, বা ইমেলদা মার্কোসের মতো এত বেশি জোড়া জুতাও চাই না, এমনকি সেই জুতা চাই না, যার ভেতর লুকিয়ে সোনা পাচার করা হয় । সম্প্রতি উদ্ভাবিত দিক-নির্দেশনার ‘বুদ্ধিমান’ জুতার মতো আমরা এমন এক বিশেষ ধরনের অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন জুতা চাই, যা আমাদের মন থেকে অনায়াসে গুম-হত্যা, ভয়-ভীতি, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ভেজাল, যানজট ইত্যাদি দৈনন্দিন এবং সামাজিক ব্যাধি ও সমস্যার গাঢ় অন্ধকার দূর করে আলোর দিক-নির্দেশনা দিবে । সবশেষে হলিউডের স্বনামধন্য অভিনেত্রী মেরিলিন মনরোর সেই বিখ্যাত উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘গিভ এ গার্ল দ্য রাইট পেয়্যার অফ সুজ, অ্যান্ড শী ক্যান কংক্যার দ্য ওয়ার্ল্ড’, অর্থাৎ নারীকে সঠিক জুতা দাও, সে তামাম দুনিয়া জয় করে দেখাবে ।-Angel Moon